বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ফুটবলার অতীতে দেশের বাইরের লিগে খেললেও তা আটকে ছিল প্রতিবেশী দেশের মধ্যেই। ক্লাব ফুটবলের মহাযজ্ঞ যে ইউরোপে, সেখানে মানের বিচারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বের স্বপ্ন সুদূর পরাহতই।
এমন একটি অবস্থায় বিশ্বখ্যাত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে যদি কোনো বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের নাম চলে আসে, তাতে বসতে হয় একটু নড়েচড়েই। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ মাতাচ্ছেন প্রথম বাংলাদেশী ফুটবালার হামজা দেওয়ান চৌধুরী, খেলেছেন ইংল্যান্ডের অনুর্ধ্ব-২১ জাতীয় দলে।
হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামের দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ চৌধুরী এবং মা রাফিয়া চৌধুরীর তিন সন্তানের সবার বড় ঝাঁকড়া চুলের হামজা চৌধুরী। একটি বিশেষ কারণে হামজাকে নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে বেশ মাতামাতি। সেটি হলো মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল সেই সঙ্গে এই তরুণ বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান।
যে কারণে পাশ্চাত্য ফুটবলের রঙিন দুনিয়ায় বাংলাদেশের নামটিও বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। সেই সাথে হামজাকে নিয়ে গর্ববোধ করছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। বিস্ময়কর হামজার ফুটবল প্রতিভা জানতে হলে ধারণা থাকতে হবে ইংলিশ ফুটবলের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সর্ম্পকে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের বাইরে ফুটবল জগতের অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ আসর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। এই লিগের মোট চারটি ধাপ। দেশের সেরা ২০টি ক্লাব নিয়ে হয় প্রিমিয়ার লিগ। দ্বিতীয় সারির ২৪টি ক্লাব খেলে চ্যাম্পিয়নশিপ। তারপরে যথাক্রমে ‘লিগ ওয়ান’ এবং ‘লিগ টু’। এই দুটি লিগেও ২৪টি করে ক্লাব।
চার ধাপের মোট ৯২টি ক্লাবের সমন্বয়ে গঠিত ইংলিশ ফুটবল লিগের প্রতিটি ধাপই একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। এসব লিগ পর্বের ক্লাবগুলো পেশাদার ক্লাব হিসেবে স্বীকৃত। প্রিমিয়ার লীগের ২০১৬ সালের চ্যাম্পিয়ন হয় লেস্টার সিটি। এই ক্লাবের হয়ে গত মৌসুমে (২৮ নভেম্বর ২০১৭) হামজার অভিষেক ঘটে ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসরে।
এবারও শীর্ষস্থানীয় এই ক্লাবের মূল দলে আছেন বাঙালি পরিবারের সন্তান হামজা চৌধুরী। মোট ৩০ জনের সমন্বয়ে হয় ক্লাবের মূল দল। পারফরম্যান্সের ওপর মাঠে নামার বিষয়টি নির্ভর করে। লেস্টার সিটির অনূর্ধ্ব–২৩ দলের অধিনায়ক হামজা চৌধুরী অথচ বয়স ছুঁয়েছে কেবল ২১ বছর।
কিন্তু মাঠের ক্ষিপ্রতায় বয়সের সীমা ডিঙিয়েছেন মূল দলে গিয়ে দুনিয়ার বাঘা বাঘা ফুটবলারকে পেছনে ফেলে গত মৌসুমে লেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগের মোট আটটি ম্যাচ খেলেন। এর আগে ২০১৫-১৬ মৌসুমে বার্টন অ্যালভিয়ন হামজাকে ভাড়া করে (লোন) নিয়ে যায়। ক্লাবটির পক্ষে ১৮ বছর বয়সেই খেলেন লিগ ওয়ান।
ভালো খেলে ক্লাবটি ওই বছর চ্যাম্পিয়নশিপে উন্নীত হয়। পরের বছর বার্টন অ্যালভিয়ন আবারও হামজাকে ভাড়ায় নিয়েছিল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের জন্যও খেলছেন হামজা। গত বছরের ২৬ মে অনূর্ধ্ব–২১ জাতীয় দলে তাঁর অভিষেক। ইতোমধ্যে মেক্সিকো, বাহরাইন, আলজেরিয়া, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন। যারা ফুটবল প্রতিভা সম্পর্কে ধারনা রাথেন তারা সহজেই বুঝেন অচিরেই হামজা ইংল্যান্ড মূল দলে খেলবেন।
হামজার জন্ম ইংল্যান্ডের লাফবারা শহরে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়। হামজা দেওয়ানের মা রাফিয়া চৌধুরী জানান, ‘ছোটবেলা থেকেই তার ফুটবলের প্রতি ছিল বেশ ঝোঁক। যে কারণে চার বছর বয়স থেকেই ফুটবল খেলতে নিয়ে যেতাম। পাঁচ বছর বয়সে হামজাকে লাফবারা ফুটবল ক্লাবে ভর্তি করা হয়। তখনই নিজের চেয়ে বয়সে দু-এক বছরের বড়দের সঙ্গে খেলত হামজা। ছয় বছর বয়সে এক ম্যাচ খেলতে গিয়ে ফুটবল ক্লাব নটিংহাম ফরেস্টের খেলোয়াড় অনুসন্ধানী দলের নজরে পড়ে হামজা। কয়েক দিন পর অন্য একটি ম্যাচে লেস্টার সিটির অনুসন্ধানীরাও তার দিকে দৃষ্টি ফেলে। উভয় দলই তাকে নিতে চায়।’
হামজার বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ চৌধুরী বললেন, ‘দুটি ক্লাব থাকে নিতে চাইলে আমরা শেষ পর্যন্ত লেস্টার সিটিতে হামজাকে ভর্তি করি। স্কুল ছুটির পর সপ্তাহে দুদিন করে প্রশিক্ষণ। শনি ও রোববার থাকত ম্যাচ। এ কারণে আমরা লেস্টার শহরে চলে আসি লাফবারা শহর থেকে। ২০১৩ সালে জিসিএসই (বাংলাদেশে এসএসসি) সম্পন্ন করার পর লেস্টার সিটি একাডেমিতে দুই বছরের বৃত্তি পায় হামজা। ফুটবল প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পড়াশোনারও দায়িত্ব নেয় তারা। সাধারণত ১৮ বছর বয়স হলেই পেশাদার ফুটবলার হিসেবে চুক্তি করতে হয়।’