শীর্ষ খবর

সিলেটে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা : নগরীতেও বন্যার আশংকা

আজকের সিলেট প্রতিবেদক: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। জেলার বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজ শুক্রবারও নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন উপজেলার নিচু এলাকা। সুরমা সিলেট পয়েন্টেও পানি প্রায় বিপদসীমা স্পর্শ করে ফেলেছে।

নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ও ধলাই এবং গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি ও জাফলং পাথর কোয়ারির সকল প্রকার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে এসব পাথর কোয়ারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় দুই লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।

পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ। জেলা ও উপজেলা শহরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিভিন্ন নিচু এলাকার। এমনকি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেটের শতাধিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

এদিকে, বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে সিলেট নগরীর নিচু এলাকাগুলোতে। বিশেষ করে মহানগরীর নিম্নাঞ্চলগুলোর জনপ্রতিনিধিরা প্রস্তুতি শুরু করেছেন। যদি বন্যার পানি বস্তির ঘরবাড়িগুলোতে প্রবেশ করতে শুরু করে তাহলে জানমালের নিরাপত্তা বা ক্ষয়-ক্ষতি যাতে কম হয় তার প্রথমিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।

বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। উজানে, ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এ সময়টাতে তুমুল বৃষ্টিপাত হয়। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলেও বৃষ্টি ঝরে অঝোর ধারায়। এবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব বেশি নয়। তাই নদ-নদীর পানি এতদিন মোটামুটি কম ছিল। তবে গত কয়েকদিন উজানের মতো সিলেট অঞ্চলেও বৃষ্টি ঝরছে। আর সাথে সাথে ফুঁসতে শুরু করেছে সুরমা কুশিয়ারা।

বৃহস্পতিবার সুরমা সিলেটে বিপদসীমা থেকে মাত্র ৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সিলেটের আকাশে বৃষ্টি দেখছেন আবহাওয়াবিদরা। সুতরাং আরো বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির পানি উজান থেকে নেমে আসছে দ্রুত, অনেকটা পাগলা ঘোড়ার মতো। এ অবস্থায় সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে শোনা যাচ্ছে বন্যার পদধ্বনি।

সিলেট মহানগরীর নিম্নাঞ্চলগুলো বরাবরই বন্যাপ্রবণ। সুরমার পানি যখন আর ছড়াখালে টানে না, বরং নদী থেকে উজান দিকে ঠেলে শহরে প্রবেশ করে তখন কেউ আর নিরাপদ থাকে না। বিশেষ করে কলোনি বা বস্তিগুলোতে প্রবেশ করে। এতে নিম্ন-আয়ের মানুষেরা দুর্ভোগে পড়েন বরাবর।

এবারও তেমন আশঙ্কা জেগে উঠেছে। বিশেষ করে ১০, ২৩, ২৪, ২৭নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি সবসময়।

কোম্পানীগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন জানান, টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদের পানি বাড়ছে। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডুবে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত ১০০টির বেশি গ্রামের মানুষ। উপজেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এছাড়া ৬০টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

এদিকে টানা বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় উপজেলার অন্যতম পর্যটন স্পট সাদা পাথর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ও প্রবল স্রোতের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে গত বুধবার থেকে কয়েক হাজার পর্যটক ওই পর্যটন স্পট না দেখেই ফিরে যাচ্ছেন। এছাড়াও উপজেলায় সকল ধরনের পাথর ও বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

এছাড়া ধলাই, পিয়াইন ও জাহাজ খালি অববাহিকায় পানি বৃদ্ধির কারণে উপজেলার সবকটি হাওর তলিয়ে গেছে। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৮০ ভাগ গ্রামের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে। এসব গ্রামে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় উপজেলার ৬০টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সেখানে অনেক পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিজেন ব্যানার্জী জানান, ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত কিছু এলাকা পরিদর্শন করেছি। উপজেলার সকল আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় উপজেলার সকল দফতর সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে এবং একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হচ্ছে। আর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সিলেটের গোয়াইনঘাটে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় প্রায় সবকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলসহ উপজেলার সিংহ ভাগ এলাকার মানুষ পানি বন্ধী হয়ে পড়েছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে গোয়াইনঘাটের পিয়াইন,সারী এবং গোয়াইন অববাহিকায় নদ-নদীর পানির বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

টানা ভারী বর্ষণের ফলে সৃষ্ট বন্যায় জেলা সদরের সাথে গোয়াইনঘাটের যোগাযোগ রক্ষাকারী সিলেট, সারী গোয়াইনঘাট সড়ক, সিলেট সালুটিকর গোয়াইনঘাট সড়কসহ সবকটি সড়কেই কোথাও হাটু পানি কোথাও কোমর পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। আকষ্মিক বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় গোয়াইনঘাটের প্রায় সবকটি এলাকায় বিদ্যালয় সমূহ পানি বন্ধী হয়ে পড়েছে। যার ফলে পড়ায় অঘোষিত ভাবে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিপদ সীমার উপর দিয়ে নদ-নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ায় জাফলং, বিছনাকান্দিসহ কোয়ারী এলাকাগুলোতে পাথর,বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে নিম্নাঞ্চল ও হাওর এলাকায় পানি বন্ধী মানুষের দূর্ভোগ হাহাকার মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সারীঘাট পয়েন্টে সারী নদীর পানি বিপদ সীমার ১১.৭৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সকাল ৬টায় ১২.৩০ মিটার এবং সকাল ৯টায় ১২.১৯ মিটার বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জাফলং পয়েন্টে পিয়াইন নদীর পানি সকাল ৬টায় ১২.৯৭ মিটার এবং ৯টায় ১২.৭৩ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে বৃহস্পতিবার সকালে মোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১২৯ মি.মি.।

গোয়াইনঘাট উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম জানান, এখানে উপজেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন নিচু এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার দুটি পাথর কোয়ারি বন্ধ রয়েছে। প্রায় ৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত কুমার পাল জানান, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি বৃদ্ধির খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। উপজেলার প্রত্যকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে মোকাবেলা করে দ্রুত রিপোর্ট প্রদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ত্রাণসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা প্রদানে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরও সংবাদ

Close