আজকের সিলেটসুনামগঞ্জ
এমপি রতনের ছোঁয়ায় টাকার পাহাড় সুনামগঞ্জের ‘ট্রলার মোস্তাক’র
ট্রলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন সুনামগঞ্জের মোস্তাক আহমদ। এলাকায় তিনি ‘ট্রলার মোস্তাক’ হিসেবে বেশি পরিচিত। ‘রতন নামক আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে এক সময়ের ট্রলারচালক মোস্তাক এখন কোটিপতি।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি হওয়ার পর ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন শুধু নিজের ভাগ্যই বদল করেননি। তার ছোঁয়া পেয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন তার সহযোগীরাও। তাদেরই একজন মধ্যনগর থানা যুবলীগ সভাপতি মোস্তাক আহমদ।
থানা পুলিশের কাছ থেকে মোটা অংকের মাসোহারা, বিনিয়োগ ছাড়াই প্রভাব খাটিয়ে জলমহাল থেকে অর্থ আদায়, ঠিকাদারি কাজে ভাগ বসানো, তদবির বাণিজ্য ছাড়াও মাদকের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন মোস্তাক।
কুঁড়েঘরে জন্ম নেয়া মোস্তাকের ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর বাজারে ৩ তলা পাকা বাড়ি ছাড়াও তিনি এখন চার-চারটি বাড়ির মালিক। গত ১০ বছরের ব্যবধানে বহু জমির মালিক হওয়া ছাড়াও হরেক রকম ব্যবসাও দাঁড় করিয়েছেন তিনি এরই মধ্যে। ছেড়ে দিয়েছেন ট্রলার চালানোর কাজটি। সরকারি জায়গা দখলের অভিযোগ তো আছেই।
একাধিক ব্যাংক হিসেবে রয়েছে তার লাখ লাখ টাকা। রাজধানী টাকার অভিজাত এলাকায় বসবাস করা ছাড়াও চড়েন দামি গাড়িতে। মোস্তাক ছাড়াও তার আরও ১০ ভাই গোটা এলাকা দাবড়ে বেড়াচ্ছেন।
ধর্মপাশার এক জনপ্রতিনিধি যুগান্তরকে জানান, মোস্তাকরা ২০০৮ সালের আগে ট্রলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমপি রতন এলাকায় আসার পর থেকে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটতে থাকে। ট্রলার চালানো ছেড়ে যোগ দেন রাজনীতিতে। এমপির কাছের লোক হওয়ায় এখন এলাকায় সবচেয়ে প্রভাবশালী তারা।
মোস্তাক ও তার ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে আপনারা এলাকার শামীম আহমদ মুরাদ, রেজাউল করীম শামীম, আলমগীর কবির ও নুরুল হুদা মুকুটসহ অনেকের সম্পর্কে খোঁজখবর নেন, তারা কী ছিল আর এখন কী হয়েছে।
তিনি বলেন, কেউ জমিদারের ঘরে জন্ম নেয়নি, আমার বাবাও কৃষক ছিলেন। দয়া করে আপনারা এদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেন। বিষয়টি স্পর্শকাতর, মন্তব্য করব না। মন্তব্য করে কোনো লাভ হয় না।
সম্প্রতি ঢাকার অ্যাবাকাস কনভেনশন সেন্টারে জাঁকজমকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন মোস্তাক। বিয়ের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী, এমপি, আ’লীগ নেতাকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও বহু লোক যোগ দেন। আড়ম্বরপূর্ণ ও ব্যয়বহুল এ বিয়ের অনুষ্ঠান এখন এলাকাবাসীর মুখে মুখে।
বলাবলি হচ্ছে, মাত্র এক দশক আগেও ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করা একজন সাধারণ মাঝি এক আশ্চর্য আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন নিশ্চয়ই। না হলে এত বিত্ত-বৈভবের মালিক তিনি হন কিভাবে।
এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে, ঢাকার অভিজাত এলাকায় তার একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি ও দামি গাড়ি রয়েছে। পরিবার নিয়ে মোস্তাক ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় বাস করছেন। এমপির প্রিয়ভাজন হওয়ায় ঢাকায় বসেই সুনামগঞ্জের সবকিছুর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। রয়েছে একটি নিজস্ব বাহিনীও।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মোস্তাক আহমেদ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি কামাউড়া গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে। ১০ বছর আগেও ট্রলার চালিয়েই সংসার চালাতেন মোস্তাক। ফলে এলাকায় তিনি ‘ট্রলার মোস্তাক’ নামেই বেশ পরিচিত।
২০০৬ সালে উপজেলার মধ্যনগর বাজার উন্নয়নের কাজ পায় পায়েল ট্রেডিং কর্পোরেশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী হলেন ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন।
ট্রলারে মালামাল পরিবহনের কারণে তৎকালীন ঠিকাদার রতনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে মোস্তাকের। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-১ আসনে এমপি পদে বিজয়ী হন সেই পায়েল ট্রেডিং কর্পোরেশন স্বত্বাধিকারী ঠিকাদার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। উড়েএসে জুড়ে বসা এমপি রতনকে স্থানীয় নেতারা গ্রহণ না করায় অনুগত হিসেবে মোস্তাক ও তার ১০ ভাইকে কাছে টেনে নেন।
এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা মোস্তাকের। একপর্যায়ে মধ্যনগর টু কলমাকান্দা, মধ্যনগর টু ঠাকোরকোনা রুটে ভাড়ায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানোর কাজ ছেড়ে দেন তিনি। মধ্যনগর থানা যুবলীগের কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে যান মধ্যনগর থানা যুবলীগের আহ্বায়ক। পরে বাগিয়ে নেন মধ্যনগর থানা যুবলীগের সভাপতির পদটিও। গোটা এলাকায় রাজত্ব কায়েম করেন মোস্তাক ও তার ১১ ভাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের মধ্যনগর শাখায় রয়েছে তার একাধিক অ্যাকাউন্ট। সোনালী ব্যাংক মধ্যনগর শাখায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রিন্স এন্টারপ্রাইজ’র নামে মোস্তাকের (নং- ৫৯০৭১০২০০০৩৮৯) অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এ বছর অ্যাকাউন্টে ৬০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। এখনও এ অ্যাকাউন্টে রয়েছে ৩০ লাখ টাকারও বেশি।
একই শাখার তার আরও একটি (নং- ৫৯০৭২০০০০০৩৪১) অ্যাকাউন্টে গত ২ বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে প্রায় কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়।
২০১২ সালে মধ্যনগর বাজারের ঠাকোরকোনা ট্রলার ঘাট এলাকায় সরকারি খাস জমি দখল করে সেখানে আনোয়ারা ম্যানশন নামে ভবন নির্মাণ করেছেন মোস্তাক। ওই বছরই মধ্যনগর থানার সামনে জনৈক মিনা দে’র লিজ নেয়া জমি দখল করে সেখানেও ভবন করেছেন।
মধ্যনগর মহেশখোলা রোডের হাসপাতালের পাশে সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে লিজ নিয়ে সেখানে টিনশেড বাড়ি করেছেন। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে নানা ক্ষোভ রয়েছে।
এমপি রতনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মোস্তাকের বড় ভাই আবদুস শহীদ আজাদও ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। মধ্যনগর বিপি উচ্চ বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য থাকা অবস্থায় স্কুলের এক ছাত্রীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করা ছাড়াও তাকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। পরে এমপি রতনের মধ্যস্থতায়ই বিষয়টি সুরাহা হয়।
এলাকায় আজাদের রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। মোস্তাকের অন্য দুই ভাই রেজাউল ও আল-আমিনের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। এমপি রতনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে আজাদ বাগিয়ে নিয়েছেন মধ্যনগর থানা কমিউনিটি পুলিশের সেক্রেটারির পদটিও।
দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, গত উপজেলা নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মনোনীত প্রার্থী শামীম হোসেন মুরাদের সরাসরি বিরোধিতা করে এমপি রতনের ভাইকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী করার পেছনে মোস্তাকসহ তার ১১ ভাইয়ের বিরাট ভূমিকা ছিল।
ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আপনার মাধ্যমে এ প্রথম দখলের কথা জানলাম। খোঁজ নিয়ে তথ্য সঠিক হলে অভিযান চালিয়ে সরকারি জমি দখলমুক্ত করা হবে। মধ্যনগর থানার ওসি সেলিম নেওয়াজ ছুটিতে।
কথা হয় ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এসআই সোহেল আহমদের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মোস্তাককে মোটা অংকের মাসোহারা দেয়ার বিষয়টি আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম। এরকম কোনো কিছু জানি না। কমিউনিটি পুলিশের কমিটি অনেক আগের। দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিতর্কিত কিনা জানি না। আমরা জানি তারা এলাকার রাজনীতিবিদ।
সব অভিযোগ অস্বীকার করে মধ্যনগর থানা যুবলীগ সভাপতি মোস্তাক আহমদ যুগান্তরকে বলেন, মধ্যনগর বাজারে শেষ মাথায় আমরা তিন ভাই মিলে দুই তলা একটা বিল্ডিং করেছি। এছাড়া আমাদের আর কোথাও পাকা দালান নেই। কখনোই ট্রলারচালক ছিলাম না, সব সময়ই আমাদের ৪-৫টি ট্রলার থাকে। মাঝিরা চালায়। এখনও একটি ট্রলার রয়েছে।
ব্যাংকে কোনো টাকা নেই দাবি করে মোস্তাক বলেন, যা আছে তা একটি ব্যাংক স্টেটমেন্টের জন্য। আমার ভাই আজাদের কোনো বাহিনী নেই, রেজাউল ও আল-আমিন মাদক তো দূরের কথা কোনো ধরনের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নয়। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটা আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
সরকারি জমিতে পাকা দালান করা যায় কিনা জানি না উল্লেখ করে মোস্তাক বলেন, রিপোর্ট না করলে হয় না। গরিবদের মেরে কী করবেন। আর যদি লেখতেই হয় যাচাই-বাচাই করে লিখবেন।
সূত্র- যুগান্তর