শীর্ষ খবর

করোনায় আক্রান্তের বেশি ঝুঁকি ‘এ’ এবং কম ‘ও’ গ্রুপের রক্ত!

করোনাভাইরাস যতটা বিচিত্র তার চেয়ে বেশি বিচিত্র মানুষের শরীরে উপসর্গ সৃষ্টিতে। একেকজন মানুষের দেহে তুলে ধরে একেক রকম। উপসর্গের এই বৈচিত্র্যে বিজ্ঞানীরা রীতিমতো বিস্মিত।

আক্রান্তদের কেউ কেউ অত্যন্ত দ্রুত গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, কারো দেহে দেখা যাচ্ছে খুবই মৃদু উপসর্গ। আবার অনেকের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পজিটিভ বলে নিশ্চিত হওয়ার পরও কোনো উপসর্গই দেখা যাচ্ছে না।

তাই প্রশ্নটি বারবারই ঘুরেফিরে আসছে- করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কার ক্ষেত্রে কতটা? এটি কি আগে থেকে অনুমান করা এবং সে অনুযায়ী হুঁশিয়ার হওয়া সম্ভব? এ নিয়ে চলছে বহু গবেষণা, প্রতিনিয়তই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করছেন।

সম্প্রতি কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, মানুষের রক্তের টাইপ বা গ্রুপের সাথে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির সম্পর্ক আছে।

বিজ্ঞানীরা প্রথম দিকে রক্তের ধরনের সঙ্গে করোনা  সংক্রমণের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করতেন না। তবে এখন গবেষকরা দেখছেন, এ দুটির মধ্যে সম্পর্ক আছে এবং এ, বি বা এবি টাইপ রক্তবিশিষ্ট মানুষের করোনা সংক্রমিত বা গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এমনকি কভিড-১৯-এ কার মৃত্যুর ঝুঁকি কতটা- তার আভাস পেতেও সহায়ক হতে পারে রক্তের টাইপ।

রক্তের ধরনের সঙ্গে কভিড-১৯ রোগ কীভাবে সম্পর্কিত? 
বিবিসির বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদদাতা হেলেন ব্রিগস লিখছেন, টোয়েন্টিথ্রিঅ্যান্ডমি নামের একটি জেনেটিক টেস্টিং কম্পানির চালানো একটি গবেষণায়ও বলা হচ্ছে, যাদের রক্তের টাইপ ‘ও’ – তাদের কভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনা – এ, বি বা এবি টাইপের রক্তের মানুষের চেয়ে ৯ থেকে ১৮ শতাংশ কম।

সাত লাখ ৫০ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, টেস্টে কভিড পজিটিভ ফল পাওয়া গেছে এমন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রক্তের টাইপ ‘ও’ – এমন লোকের সংখ্যা সবচেয়ে কম। কভিড পজিটিভদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছেন ‌’এবি’ রক্তের অধিকারীরা। এই গবেষকরা দেখেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের বয়স, লিঙ্গ, ওজন, জাতিগত বা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং আগে থেকে থাকা স্বাস্থ্য সমস্যা – এগুলো বিবেচনায় নেওয়ার পরও, কভিড সংক্রমণে ঝুঁকির ক্ষেত্রে রক্তের ধরনের ভূমিকা একই থাকছে।

গবেষকরা অবশ্য বলেছেন তাঁদের এই জরিপ এখনো প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। স্পেন, ইতালি ও চীনে চালানো জরিপেও একই রকম আভাস মেলেছে তবে অন্য একাধিক জরিপেও রক্তের টাইপের সঙ্গে কভিড সংক্রমণ কত মারাত্মক হবে তার একটি সম্পর্ক দেখা গেছে।

গত সপ্তাহেই ইতালি ও স্পেনে চালানো জেনোমওয়াইড অ্যাসোসিয়েশনের চালানো এক জরিপে বলা হয়- করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের রক্তের টাইপ ‘এ’ – তাদের অক্সিজেন বা ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

মার্কিন দৈনিক দি নিউ ইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, মানুষের জিন, রক্তের টাইপ এবং কভিড-১৯ – এগুলোর মধ্যে পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক প্রথম চিহ্ণিত করে ইউরোপের একটি জরিপ।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, ইতালি ও স্পেনের সাতটি হাসপাতালের এক হাজার ৯৮০ জন রোগীর ওপর এ জরিপ চালানো হয়। এতে বলা হয়, ‘এ’ টাইপ রক্তের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি, এবং ও টাইপের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম বলে দেখা গেছে।

বলা হয়, যাদের রক্তের ধরন এ পজিটিভ, তারা কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে অক্সিজেন বা ভেন্টিলেটর দরকার হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ বেশি। এর আগে চীনে চালানো একটি জরিপেও এমন তথ্য পাওয়া যায়।

মেডআরকাইভ অনলাইন জার্নালে প্রকাশিত ওই জরিপে বলা হয়, উহান ও শেনঝেনের তিনটি হাসপাতালের দুই হাজার ১৭৩ জন করোনাভাইরাস রোগী এবং আক্রান্ত হয়নি এমন লোকদের উপাত্ত তুলনা করে দেখা গেছে, এ টাইপ রক্তের লোকদের কভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সেখানেও দেখা যায়, ‘ও’ টাইপ রক্তের মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম।

তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য যেসব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, তা পালন না করার জন্য এসব জরিপ ব্যবহার করা ঠিক হবে না।

ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেরি কুশম্যান বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে এমন কথা দেখা গেছে যে একটি পরিবারের যে সদস্যের রক্তের টাইপ ‘ও’, তাকে কেনাকাটা করার জন্য দোকানে পাঠানো উচিত কি না।’

‘কিন্তু কারো রক্তের টাইপ ‘ও’ বলে তাকে কম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে – এমন চিন্তা করা কারোই উচিত হবে না। আমরা চাই না যে কারো রক্তের টাইপ ‘ও’ বলে সে নিজেকে সুরক্ষিত ভাববে – এমন ধারণা তৈরি হোক।’

এই গবেষণাগুলোর সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা বলেছেন, রক্তের টাইপই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির পেছনে প্রধান কারণ কি না, বা এর পেছনে অন্য কোনো জেনেটিক উপাদান কাজ করছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। রক্তের ধরন নির্ধারিত হয় বংশানুক্রমিকভাবে। মানুষের রক্তের ধরন প্রধানত চারটি – এ, বি, এবি এবং ও। প্রত্যেকের রক্তের ধরন নির্ধারিত হয়, তার বাবা-মায়ের থেকে পাওয়া জিনের মাধ্যমে।

করোনাভাইরাস সংক্রমিত কিছু লোকের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া এবং অন্য কিছু লোকের ক্ষেত্রে মৃদু উপসর্গ হওয়া – এর পেছনে কোনো জেনেটিক কারণ কাজ করছে কি না, তা সম্প্রতি অনেকগুলো গবেষণা চালানো হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানব জেনোমের দুটি বিন্দুতে যে পার্থক্য দেখা যায়, তার সঙ্গে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগী শ্বাসতন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়ার বর্ধিত ঝুঁকির সম্পর্ক রয়েছে। এই দুটি বিন্দুর একটি এমন কিছু জিন আছে, যা মানুষের রক্তের টাইপ নির্ধারণ করে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের রহস্য নিয়ে নতুন ভাবনা 
রিপোর্টে বলা হয়, ওই জরিপটি অন্য কিছু দিক থেকেও ছিল বিস্ময়কর। বলা হয়, মানুষের দেহকোষের বাইরের দিকে থাকা এ সি ই টু নামে একটি প্রোটিনের সাথে নিজেকে আটকে দিয়ে করোনাভাইরাস কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু যারা কভিড-১৯-এ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন – তাঁদের ক্ষেত্রে এ সি ই টু-র জেনেটিক পার্থক্য কোনো ভূমিকা রাখেনি বলে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন।

‘তার মানে হলো, যেসব দিকের দিকে আমরা অপেক্ষাকৃত কম নজর দিয়েছি হয়তো সেগুলোই কভিড-১৯-কে জীবনাশঙ্কা তৈরির মতো পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে’ – বলেন আন্দ্রে ফ্রাংক, যিনি এই জরিপের অন্যতম প্রণেতা, এবং জার্মানির কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জেনেটিক বিশেষজ্ঞ।

বিজ্ঞানীরা এর মধ্যেই দেখেছেন যে আক্রান্তদের বয়স, এবং আগে থেকেই হাঁপানি, হৃদরোগ, বা ডায়াবেটিসের মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল এমন লোকদের কভিড-১৯=এ গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আরো দেখা গেছে, করোনাভাইরাসে নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি মারা গেছেন। কিছু জরিপে জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও ঝুঁকি বাড়ায় বলে দেখা গেছে।

সম্প্রতি ব্রিটেনে কিছু গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, ভারতীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মারা যাওয়ার ঝুঁকি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বেশি।

সূত্র : বিবিসি বাংলা।

আরও সংবাদ

Close