আজকের সিলেট

প্রবাসী স্বামী থেকে এইচআইভিতে আক্রান্ত স্ত্রী-সন্তান : গৃহবধূকে বাড়িছাড়ার পায়তারা

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ছেলে থাকতেন সৌদি আরবে। দেশে আসার পর ধুমধাম করে বিয়ে হলো। স্ত্রীর কোল জুড়ে এলো ফুটফুটে এক শিশু। স্বামী ফিরে গেলেন সৌদি আরবে। সুখের সংসারে হঠাৎ নেমে এল ঘোর অন্ধকার। কে জানতো সৌদি থেকে তার স্বামী নিয়ে আসছেন মরণঘাতী এইডসের জীবানু-এইচআইভি!

আর তাই স্বামীর অসচেতনতায় একসময় নিজেও পজেটিভ হলেন, তার গর্ভে থাকা সন্তান রত্নটিও জন্মালো সেই ঘাতক ব্যাধি নিয়ে। সেজনা বেগমের স্বামী ইতিমধ্যেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এখন নিজের জীবনও প্রায় যায় যায়। একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

কিন্তু তবু নরকযন্ত্রণায় বর্তমানে অতিষ্ঠ বছর ত্রিশের এই যুবতি। শাশুড়ি ও শ্বশুরপক্ষের অত্যাচারে চোখে রীতিমতো অন্ধকার দেখছেন। এ দুঃসময়ে আদর-ভালোবাসার পরিবর্তে স্বামী-পক্ষের লোকজনের অত্যাচারে তার ভিটে ছেড়ে পাশেই বাবার বাড়ি আশ্রয় নিতে হয়েছে ।

সিলেট অঞ্চলে ‘স্বামী প্রবাসী’- এটা একটা বিশেষ ব্যাপার। সেজনার জীবনে এই বিশেষ বর ছিলেন তার চাচাতো ভাই দক্ষিণ সুরমার তেতলি ইউনিয়নের টিল্লাবাড়ি গ্রামের মৃত মিম্বর আলীর ছেলে মৃত কাওছার আহমদ। বিয়ের কিছুদিন পর অনুভব করেন তার গর্ভে এসেছে কাংখিত অতিথি। তারই সন্তান। সেই সন্তানকে গর্ভে রেখেই স্বামী চলে যান আবার তার কর্মস্থল সৌদিআরব। যথারীতি হাসি-আনন্দ-উচ্ছাস আর উল্লাসে চলছিল জীবন।

কিন্তু সেই জীবনেও ছেদ পড়ে। কাওছার অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণ হয়, তিনি এইচআইভি পজিটিভ। এমন সংবাদে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সেজনা ও তার পরিবারের সদস্যদের। দেশে পরীক্ষা করানোর পর জানলেন তিনি নিজেও পজিটিভ।

ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠে সেজনার জীবন। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন বহুদিন। ২০১২ সালের দিকে মৃত্যুবরণ করেন তার স্বামী কাওছার।

একসময় সবকিছু সয়ে যায়- মানুষের জীবনটা এমনই। সেজনারও একসময় সবকিছু সয়ে গেলো। মৃত্যুকে বুকের ভেতর সযত্নে লালন পালন করতে করতেই প্রসব করলেন সত্যিকারের রাজকুমারের মতোই এক ফুটফুটে ছেলে সন্তান। তার হাতপা চোখমুখ সবকিছুই স্বাভাবিক। কিন্তু তবু খুশির বদলে তিনি বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে নিজের ভাই-পিতা আর আত্মীয়স্বজনের দেয়া সাহায্য সহায়তায় সেই সন্তানকে বড় করতে থাকেন। আজ তার বয়স ১০ বছর। বলাইবাহুল্য, সেও এইচআইভি পজিটিভ।

মা-ছেলের জীবন চলছিল কোনমতে। কিন্তু হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠলেন তার স্বামীর পরিবারের লোকজন। দুর দুর করতে থাকলেন অসহায় মা-ছেলেকে। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকলো। তাদের জানিয়ে দেয়া হলো, সেজনার স্বামী কাওছার কৃষি জমির ভাগ পান না। তাদের দেয়া হবে না। ভিটে-মাটিও নেই। সুতরাং বাড়ি ছাড়তে হবে তাদের। স্বামীর সামান্য সম্পদটুকু থেকেও বঞ্চিতের ষড়যন্ত্র চলতেই থাকে।

সেজনা জানালেন, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি তার দেবর ফয়ছল আহমদ, আত্মীয় জসিম উদ্দিন ও তার স্ত্রী রুবিনা বেগম, শাশুড়ি জমিলা খাতুন তার ঘরে ঢুকে তাকে মারধোর ও তার আসবাবপত্রের ক্ষতি করেন। তারা তার নাবালক সন্তানসহ সেজনাকে বাড়িছাড়া করেন।

অসহায় জননী ছেলে আব্দুর রহমান ইয়াছিরের হাত ধরে অশ্রু মুছতে মুছতে আশ্রয় নেন পিতার ভিটায়। এ ব্যাপারে সেদিনই তিনি দক্ষিণ সুরমা থানায় একটি সাধারণ ডায়রী করেন। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছুই করেন নি। সেজনার অভিযোগ, ঐ কর্মকর্তা বরং অভিযুক্তদের পক্ষেই কাজ করেছেন।

সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলন করেন। আবারও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তার ভাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। সেজনার উপর এমন অত্যাচারের কারণ জানতে সান নিউজের পক্ষ থেকে তার দেবর ফয়ছল আহমদের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) আখতার হোসেন বলেন, আমি এ থানায় নতুন। তবে ২ দিন আগে সেজনার ভাই এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। অভিযোগ পেয়েই আমি ঐ এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলি। এমনকি তার দেবর শাশুড়ি ও পঞ্চায়েতের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা সবাই আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টির সন্তোষজনক নিষ্পত্তি করে দিবেন। সেজনা যেমন চায় তেমনভাবে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগিতা করবেন। এতে কাজ না হলে পুলিশ সেজনা ও তার ছেলের পাশে থাকবে। তাকে সসম্মানে তার স্বামীর ভিটায় থাকতে যা যা করণীয়, আমরা তাই করতে প্রস্তুত। এমনকি তার দেবর-শাশুড়িও এ ব্যাপারে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

সর্বশেষ বুধবার সন্ধ্যায় সেজনা স্বামীর বাড়িতে ফিরে যান। সাংবাদিকদের ও পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, সবার সহযোগিতায় আমি আমার স্বামীর ভিটায় ফিরেছি। এখানেই মরতে চাই আমি।

আরও সংবাদ

Close