শীর্ষ খবর

২০২০ এঁকে দিয়েছে সিলেটের ছাত্রলীগ ও পুলিশের কপালে কলঙ্ক তিলক

কিছুক্ষণ পর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে ইংরেজী বর্ষ ২০২০ সাল। আসছে নতুন বছর ২০২১। ২০২০ সাল যেনো পুরো পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিল অশুভ বার্তা। পুরোটা বছর ভাইরাস আর নানা অঘটনে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে পুরো পৃথিবীর মানুষের জীবন।

বছরটি সিলেটবাসির জন্যও বেদনার ও কষ্টের ছিল। এ বছর একটি নয় ২টি ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম হয়েছে যা সিলেটের ইতিহাসে নেই। শান্তিপ্রিয় এবং ৩৬০ আওলিয়ার পবিত্র এ ভূমিতে এ ধরনের কাজ কেউ চিন্তাও করতে পারেনি। এ দু’টি ঘটনা কলঙ্ক তিলক এঁকে দিয়েছে সিলেটের পুলিশ ও ছাত্রলীগের কপালে।

বছরের প্রায় শেষের দিকে ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে ঘটে লোমহর্ষক এক গণধর্ষণের ঘটনা। যা সিলেটের মানুষ কখনো দেখেনি। এছাড়াও পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে তরুণ রায়হানের মৃত্যু। এ দুই ঘটনা কালিমা লেপন করেছে সিলেটে। পুরো বিশ্বজুড়ে ছিল আলোচনা-সমালোচনা। ঘটনাগুলো নিয়ে সিলেটসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়েছে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে একটি রাস্তায় প্রাইভেট কারের মধ্যেই গৃহবধূকে গণধর্ষণ করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ১২৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুরারিচাঁদ কলেজ (এমসি) ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ’র কারণে চলে ব্যাপক সমালোচনা। এ ঘটনায় দুই মাস ৮ দিনের মাথায় আদালতে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। চার্জশিটে ওই ঘটনায় গ্রেফতার আট ছাত্রলীগ কর্মীকে অভিযুক্ত করেছে পুলিশ। ৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বহুল আলোচিত এই গণধর্ষণ মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগরের শাহপরাণ (রহ.) থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য।

চার্জশিটে অভিযুক্ত আসামিরা হলেন, মামলার এজাহারনামীয় আসামি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার উমেদনগরের রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), হবিগঞ্জ সদরের বাগুনীপাড়ার মো. জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), জকিগঞ্জের আটগ্রামের কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৫), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুর (জগদল) গ্রামের বাসিন্দা ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এমসি কলেজ শাখার সভাপতি রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাটের গাছবাড়ি গ্রামের মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), মিসবাহ উর রহমান রাজন ও আইনুদ্দিন। এর মধ্যে রাজন ও আইনুদ্দিন ছাড়া অপর ছয়জন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।

তখন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের বলেন, মামলার আসামিদের ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন পেতে বিলম্ব হওয়ায় আলোচিত এ মামলার চার্জশিট দাখিলে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার তিনদিনের মাথায় পুলিশ আদালতে চার্জশিট প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে। আর হাতে পাওয়া ডিএনএ টেস্টে ধর্ষণেরস্থল থেকে সংগৃহীত আলামতের সঙ্গে মামলার আসামিদের ডিএনএর মিল পাওয়া যায়।

এর আগে গত ১ অক্টোবর ও ৩ অক্টোবর দুদিনে এ মামলায় গ্রেফতার ৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি সেন্টারের ডিএনএ ল্যাবে নমুনা সংগ্রহের পর পাঠানো হয় ঢাকার ল্যাবে। সেখান থেকে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন প্রথমে আদালতে এসে পৌঁছায়। পরবর্তীতে এ প্রতিবেদন তদন্ত কর্মকর্তার হাতে এসে পৌছে ২৯ নভেম্বর।

নির্যাতিতার স্বামীর দায়েরকৃত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব ও রেঞ্জ পুলিশ অভিযান চালিয়ে মামলার এজাহার নামীয় ৬ জনসহ মোট ৮ জনকে গ্রেফতার করে। পরে গ্রেফতার আটজনকেই ৫ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হলে তারা সকলেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। বর্তমানে তারা জেলহাজতে আটক রয়েছেন। এর সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, হাইকোর্টের নিদের্শে গঠিত তদন্ত কমিটি সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হলরুমে গত ৪ অক্টোবর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত এ ঘটনায় গণশুনানি করে। পরে কমিটির সদস্যরা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের গণধর্ষণের ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে গত ১৬ অক্টোবর ১৭৬ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন হাইকোর্ট বেঞ্চে জমা দেওয়া হয়েছে। যার শুনানি হয় ২০ অক্টোবর। এদিন শুনানি শেষে প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এদিকে গণধর্ষণের এ ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে ২৬ অক্টোবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও কলেজের অধ্যক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দোহাই দিয়ে কলেজ কমিটির এ প্রতিবেদনটি সিলগালা করে রাখেন।

এছাড়া গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িত চার আসামির ছাত্রত্ব এবং সনদ বাতিল করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে এমসি কলেজ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন, সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসান।

এর আগে ঘটনার কয়েকদিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গণধর্ষণের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি এমসি কলেজে তদন্ত করতে আসে। তদন্ত শেষে তারা তাদের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। বর্তমানে এ মামলাটি দুইভাগে বিভিক্ত হয়ে দুটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

এদিকে- গত ১১ অক্টোবর ভোর রাতে রায়হানকে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন করা হয়। পরে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর সকাল ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু ‘রায়হান ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন’ পুলিশের তরফ থেকে দাবি করা হলেও নিহতের পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগ ছিল পুলিশ ধরে নিয়ে ফাঁড়িতে নির্যাতন করে তাকে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।

পরিবারের অভিযোগ ও মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্ত দল ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর সত্যতা পায়। এতে জড়িত থাকায় ইনচার্জ আকবরসহ চার পুলিশকে বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্যরা হলেন- বন্দরবাজার ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাস। প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেন। ঘটনার পর অন্য ছয়জন পুলিশ হেফাজতে থাকলেও আকবর পলাতক ছিলেন।

১০ নভেম্বর দনা সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় রায়হান উদ্দিন (৩০) হত্যার মূল অভিযুক্ত সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে। ১১ নভেম্বর থেকে সাতদিনের রিমান্ড শেষে ১৭ নভেম্বর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। বর্তমানে আকবর কারাগারে আটক আছেন। আর মামলাটি বর্তামেন বিটচারাধীন। এ ঘটনায় দেশ ও বিদেশে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছ। আসছে বছর ২১-এ যেনো সিলেটের মাটিতে আর কোন অঘটন না ঘটে এ কামনা সবার। প্রশাসনও চায় আর যেনো এসব ঘটনা দেখতে না হয়।

আরও সংবাদ

Close