আজকের সিলেটসুনামগঞ্জ

সুনামগঞ্জে বাঁধ নিয়ে ব্যবসা : ‘না কাটলে কি প্রজেক্ট পাইব ইউপি সদস্য?’

বন্যার কবল থেকে হাওরের ফসল রক্ষায় প্রতিবছরই বাঁধ মেরামত ও ক্লোজার (বাঁধের ফাটলের অংশে তৈরি বড় বাঁধ) তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা ছাড় করে সরকার। আর এরই সুযোগ নিয়ে এখানে তৈরি হয়েছে বাঁধ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। বাঁধ কেটে দেওয়া, যে কোনোভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে (পিআইসিতে) ঢোকা, অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে বাঁধের টাকা লুটপাট এবং নতুন নতুন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। এই বাঁধ ব্যবসায়ীদের কারণেই একদিকে হাওর এলাকার সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না, অন্যদিকে প্রতিবছরই বাড়ছে বাঁধের কাজ।

গেল বছর ৭৪৫টি বাঁধের পিআইসি ছিল। এবার ৮৫৬টি কমিটির কথা শোনা যাচ্ছে। বাঁধের ভাঙনে গত বছর ১৩৫ ক্লোজার হয়েছে, যা এবার আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বল নজরদারির সুযোগ নিয়ে এরাই বর্ষা মৌসুমে বাঁধের স্থায়ী অংশ (বস্তি অংশ) কেটে ভাঙন সৃষ্টি করে। পরে ভাঙন অংশে কাজ করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে।

জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরপাড়ের একাধিক গ্রামবাসী জানালেন, হাওর রক্ষা বাঁধের বেশ ক’টি অংশ কেটে বড় বড় ভাঙন তৈরি করেছে এ বাঁধ ব্যবসায়ী চক্র। এখন ওই ভাঙন স্থানে ক্লোজার তৈরির জন্য পিআইসির অন্তর্ভুক্ত হতে জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের কাছে তদবির করছেন তারা।

স্থানীয়রা জানায়, বেহেলী ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামবাসীর বাধা উপেক্ষা করে গেল বর্ষায় হালির হাওরের বাঁধটি কেটে দেন গ্রামের ইউপি সদস্য মসিউর রহমান।

একই গ্রামের আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘এই ভাঙনে জমি নষ্ট হইছে। খালডাও অনেক গভীর হইছে। এখন ভরাট করতে অনেক মাটি লাগবো। প্রজেক্ট পাইবার লাগি হেরা এইডা করছে, নাইলে তো এইডা ভাঙার দরকার নাই।’

তবে গ্রামবাসীর অভিযোগ অস্বীকার করে বেহেলী ইউপির সদস্য মসিউর রহমান বলেন, ‘মামুদপুরের বাঁধ ভাঙার ব্যাপারে কিছু জানি না। গ্রামবাসীই চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেটি ভেঙেছে।’

বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অসীম তালুকদার বলেন, ‘বাঁধ কাটার এখতিয়ার তো আমাদের নেই। আমরা এটা করতে যাব কেন?’

এদিকে বদরপুর ও হাওড়িয়া আলীপুরের মাঝখানে ঘনিয়ার বিল সংলগ্ন বাঁধ এবং শনির হাওরের ঝালোখালি ক্লোজার থেকে একটু দূরের বস্তি বাঁধ কেটে বৃহৎ ভাঙন তৈরি করেছেন অবৈধ মাছ শিকারিরা। এ ছাড়া হাওড়িয়া আলীপুরের পার্শ্ববর্তী ভাঙাসহ মহালিয়া হাওরের দুই স্থানে বড় গর্ত করে বৃহৎ বরাদ্দ হাতিয়ে সরকারি অর্থ অপচয়ের চেষ্টা করছেন কথিত বাঁধ ব্যবসায়ীরা। হাওরপাড়ের বাঁধ ব্যবসায়ীদের এমন অরাজকতায় স্থানীয় পাউবো প্রশাসনের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাওরপারের কৃষকরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের জামালগঞ্জ উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী রেজাউল কবীর জানিয়েছেন, ‘পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রতি বছরই মামুদপুর গ্রামের পাশের হালির হাওরের বাঁধ কাটা হয়। এবার একই কারণে এটা করা হয়েছে। অন্যান্য ভাঙন যেগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো রাতের আঁধারে কে বা কারা করেছে তা আমাদের জানা নেই।’

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন তালুদার বলেন, বাঁধ কাটার এই অসৎ কাজ ঠেকানো যেত যদি হাওর রক্ষা বাঁধে নৌচলাচলের বা পানি বের হওয়ার অংশে রাবারড্যাম করা যেত। বাঁধের এই ব্যবসায়ীদের পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে বলে দাবি করেন তিনি।

জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ বলেন, উপজেলা পর্যায়ে বাঁধের কাজ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি আছে। ওই কমিটিতে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিনিধি আছেন। এবার কমিটির অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রকল্প হবে না। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠনে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।

সৌজন্যে : সমকাল

আরও সংবাদ

Close