খোলা জানালা

একজন লুৎফুর রহমান

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জেলা পরিষদ সিলেটের চেয়ারম্যান, সাবেক গণপরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সিলেট ইউনিটের চেয়ারম্যান এডভোকেট লুৎফুর রহমান। বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষরকারী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর্য্য পাওয়া একজন বরেণ্য ব্যক্তি। ক্লিন ইমেজের রাজনীতির জন্য তিনি দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছেই প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র।

মো. লুৎফুর রহমান সিলেট জেলার সাবেক বালাগঞ্জ থানা- বর্তমানে ওসমানীগর উপজেলাধীন ৩নং পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের বড়হাজীপুর গ্রামে ১৯৪০ ইংরেজির ৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৬২ সালে লুৎফুর রহমান এবং তার আরও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে সিলেট জেলা ছাত্রলীগ পুন:গঠন করেন। ১৯৬২ সালে লুৎফুর রহমানের নেতৃত্বে আইয়ূব খান বিরোধী আন্দোলন আরম্ভ করে ছাত্রলীগ। একই সালে হামিদুর রহমানের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি।

১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে সিলেট থেকে লুৎফুর রহমানের নেতৃত্বে ১০ জন কাউন্সিলার যোগদান করেন। পুরান ঢাকার পাকিস্থান মাঠে ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তখন পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শাহ মোজ্জেম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। ওই সম্মেলনে প্রখ্যাত আইনজ্ঞ বিচারপতি ইব্রাহিম সাহেব প্রধান অতিথি হিসাবে যোগদান করেন। এই সম্মেলনে কে.এম উবায়দুর রহমান সভাপতি সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক এবং আব্দুর রাজ্জাক সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন লুৎফুর রহমান। সামরিক সরকারের দশটি বেত্রাঘাতের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ছয় দফার পুস্তিকা বিতরণ করেন তিনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যান লুৎফুর রহমান।

১৯৭০ ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু তাকে প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেন এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে তিনি বালাগঞ্জ থানা এবং ফেঞ্চুগঞ্জ থানা নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন লুৎফুর রহমান। তিনিসহ সিলেটের আরও কয়েকজন এমপিএ এসময় আসামের করিমগঞ্জ শহরে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। করিমগঞ্জে টাউন হলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী যুবকরা জমায়েত হয়। লুৎফুর রহমান ও আব্দুল লাতিফ এম.পি.এ সাহেব টাউন হলের দায়িত্বে ছিলেন এবং যুবকদের খাওয়া-দাওয়া এবং কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিতেন।

করিমগঞ্জে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ অনেক সাহায্য করেন তাদের। এই ক্যাম্প থেকে প্রতি সপ্তাহে গেরিলা ট্রেনিং নেওয়ার জন্য যুবকদেরকে ট্রেনিং কেন্দ্রে পাঠাতেন লুৎফুর রহমান। দেওয়ান ফরিদ গাজী এম.এন.এ সাহেবের সাথে ৩ নং এবং ৪ নং সেক্টরে সিভিল এফ্যায়ার্স সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করেন তিনি।

১৯৭২ সালে তিনি গণপরিষদের সদস্য হন এবং হাতে লেখা সংবিধানে স্বাক্ষর করে সংবিধান পাশ করায় অংশগ্রহণ করে।

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে লুৎফুর রহমানকে আটক করে নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীতে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে কার্যক্রম চালিয়ে যান তিনি। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। পরবর্তী সময়ে লুৎফুর রহমান জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, এরপরে সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং সর্বশেষ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মনোনীত হন।

২০১৬ সালের ২১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অ্যাডভোকেট লুৎফুর রহমানকে সিলেট জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্বে নিয়োগ দেন। এরপর তিনি মৃত্যু পর্যন্ত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তী। মৃত্যুকালের তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি ২ ছেলে, ১ মেয়ে সহ অসংখ্য গুনগ্রাহি স্বজন রেখে গেছেন।

হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এডভোকেট লুৎফুর রহমানকে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। বৃহস্পতিবার সকালে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকায় নেয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে এই হাসপাতালেই লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় তাঁকে।

৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার অজস্র মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। শেষ বারের মতো কর্মস্থল জেলা পরিষদে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলে এক শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চোখের জল আর ফুলের শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই বিদায় জানান তাকে। বাদ জুম্মা সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জানাযার নামাজ শেষে কুমাড়পাড়াস্থ হযরত মানিক পীর (রহ.) কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

আরও সংবাদ

Close