শীর্ষ খবর
সিলেটে আতঙ্ক বেপরোয়া ট্রাক : মৃত্যুর মিছিলে ১২ দিনে ৮ জন
সিলেটে ভয়াবহ আকারে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। চলতি বছরের শুরু থেকে যেনো হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্ঘটনা। সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা কেবল বাড়ছেই। জানুয়ারি মাসের ১২ দিনে সিলেট জেলার বিভিন্ন সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৮ জন।
বেপরোয়া চালকদের অনিয়ন্ত্রিত গাড়িচালনা, চালকদের অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি এবং জনসাধারণের অসচেতনতাসহ দুর্ঘটনার মোট ১৫টি কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটে বলে পর্যবেক্ষকদের দাবি।
বছরের প্রথম দিন সিলেট-তামাবিল সড়কে ট্রাকের সাথে পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে গোলাম মোস্তফা (৫৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৯ জন। শুক্রবার সকালে শাহপরান থানাধীন পরগণাবাজার এলাকায় এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনায় নিহত গোলাম মোস্তফা ঢাকার চানখারপুল এলাকার মৃত আজিজ বেপারীর ছেলে। পুলিশ জানায়, ঢাকা থেকে মোস্তফাসহ ১০জন বুধবার একটি মাইক্রোবাসযোগে রাতে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তারা ছুটির দিনে জাফলংসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়ানোর জন্য এসেছিলেন। সকালে তাদের মাইক্রোবাসটির সিলেটের পরগণাবাজারে এলে বিপরীত দিক থেকে আসা বালুভর্তি ডাম্প ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
সর্বশেষ সোমবার (১১ জানুয়ারি) রাতে নগরীর সুবিদবাজার এলাকার ফাজিল চিশতে দ্রুতগামী ট্রাকের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। নিহতরা হচ্ছেন সজিব ও লুৎফুর। নিহত সজিববের বাড়ি নগরীর বনকলাপাড়ায় ও লুৎফুরের সুনামগঞ্জের দিরাই থানায়।
এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) সকালে নিহত সজিব আহমদের মা সালমা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ট্রাক চালক জাহেদ মিয়াকে প্রধান আসামী করা হয়। তিনি বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানার কিচক গ্রামের মৃত মোজাহারের ছেলে। এছাড়াও আরও কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে গ্রেফতারকৃত ট্রাক চালক জাহেদ মিয়াকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) বিকেলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সজিব ও লুৎফুরের ময়নাতদন্ত শেষে তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ।
শনিবার রাতে নগরীতে ট্রাক চাপায় এক জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় উত্তেজিত জনতা সড়ক অবরোধ করেন। বিমানববন্দর সড়কের খাসদবীর নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত আতাউর রহমান কুটি খাসদবীর এলাকার বাসিন্দা।
ঠিক এর আগের রাত শুক্রবারে (৮ জানুয়ারি) বিমানবন্দর সড়কে ২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে তিনজন আহত হন। এরমধ্যে সন্ধ্যারাত সাড়ে ৭টার দিকে সিলেট মহানগরীর এয়ারপোর্ট থানার মালনীছড়া চা-বাগান মসজিদের সামনে একটি নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেট কার (রেজি. নং-ঢাকা মেট্রো.-গ-৩৫-৩৯৯৮)-এর মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে মোটরসাইকেল আরোহী জয়নাল ও হৃদয় গুরুতর আহত হন।
আহতরা হচ্ছেন- সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজি গ্রামের মৃত চুনু মিয়ার ছেলে হৃদয় (২৫) ও একই উপজেলার লাউতল গ্রামের আব্দুল খালিকের ছেলে জয়নাল (২৭)।
তাদেরকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা। বর্তমানে তারা ওসমানী হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
এদিকে, একই সড়কে একই রাতে প্রায় ১২টার দিকে ঘটে আরেকটি দূর্ঘটনা। এয়ারপোর্ট থানার বড়শালা বাইপাস পয়েন্টে একটি প্রাইভেট কার (রেজি. নং-ঢাকা মেট্রো.-ভ-৮৬৬৬)-এর সঙ্গে একটি ট্রাক গাড়ির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
এতে প্রাইভেট কার আরোহী সোহেল আহমদ (২৭) গুরুতর আহত হন। তাকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। বর্তমানে তিনি ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত সোহেল সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বলিশ্বর গ্রামের মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে। দুর্ঘটনায় কবলিত প্রাইভেটকারটি উদ্ধার করা হলেও ট্রাক গাড়টি নিয়ে চালক পালিয়ে যান। সে গাড়ি ও চালকের খোঁজ করছে পুলিশ।
এর আগে গত এক সপ্তাহে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের ওসমানীনগর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ ৩ জন নিহত হয়েছেন। ৩১ ডিসেম্বর রাতে ব্যাটারি চালিত টমটমের চাপায় এক নৈশপ্রহরী (নাইট গার্ড) নিহত হয়েছে।
জানা গেছে, সিলেট বিভাগে গত এক বছরে (২০২০) ১৮৭ টি সড়ক দুর্ঘটনায় নারী,পুরুষ, শিশুসহ ২৫০ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও আহত হয়েছেন ৩৯৮ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৯ জন নিহত ও ৬৪ জন আহত হয়েছেন। সুনামগঞ্জ জেলায় ২১ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত ও ৬৪ জন আহত হয়েছেন। মৌলভীবাজার জেলায় ৪৩ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়েছেন। হবিগঞ্জ জেলায় ৭৬ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১১৪ জন নিহত ও ২১৫ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষকরা ১৫টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে- বেপরোয়া গতি, বিপদজনক ওভারটেকিং, রাস্তা-ঘাটের ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, ছোট যানবাহন বৃদ্ধি, সড়কে চাঁদাবাজি, রাস্তার পাশে হাট-বাজার ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো।
গত বছরে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী সিলেটে বিভাগের চার জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে হবিগঞ্জে। এই এক বছরে সিলেট বিভাগে ১৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫০ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৩৯৮ জন। ২০২০ সালে শুধু হবিগঞ্জেই সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ৭৬টি। এতে মারা গেছেন ১১৪ জন ও আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২১৫ জন।
অন্যদিকে নিসচা’র প্রতিবেদন অনুযায়ী সিলেট জেলায় ৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৯ জন নিহত ও ৬৪ জন আহত, সুনামগঞ্জ জেলায় ২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত ও ৬৪ জন আহত এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৪৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়েছেন। এ হিসেব পর্যবেক্ষণে দেখা গেল এক বছরে সিলেট বিভাগে চার জেলার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা হবিগঞ্জ জেলায় সর্বোচ্চ।