আজকের সিলেট
দিঘি এখন শুধু এলাকার নামেই : ভরাটের মহোৎসব থামছেই না
দিঘির শহর সিলেট- এক সময় এ নামেই চেনা যেত সিলেটকে। ছোট-বড় অর্ধশত দিঘি এ নগরকে দিয়েছিল আলাদা স্নিগ্ধতা। শহরকে ধুলাবালি ও আবর্জনামুক্ত রাখতে বছরের পর বছর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রেখেছে এসব দিঘি। অথচ সেই দিঘির শহরেই কিনা গত মঙ্গলবার সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন লাগার পর পুকুরের খোঁজে হন্যে হতে হয়েছে নগরবাসীকে।
গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সিলেটের মানুষজন পানির জন্য পুকুরের খোঁজে ছুটেছে এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায়। ছুটতে হয়েছে সুরমা নদীর বিভিন্ন ঘাটে। কারণ গত ২০-২৫ বছরে সিলেটের পুরোনো সব দিঘি একের পর এক ভরাট হয়ে গেছে, যেগুলো বিভিন্ন বিপর্যয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। বিশেষ করে গত বুধবার শহরে পানির জন্য হাহাকারের দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো।
বুধবার সন্ধ্যায় অবশ্য সিলেট নগরীসহ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও বিদ্যুতের দেখা মেলেনি মেডিকেলসহ বেশকিছু এলাকায়। তাই পানি সংকট গতকালও ভুগিয়েছে সবাইকে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান সমকালকে বলেন, করপোরেশন কখনোই দিঘি বা পুকুর ভরাটের অনুমতি দেয় না। বরং উদ্ধারের কাজ করছে। মামলা জটিলতা, স্থানীয় প্রয়োজন ও মালিকানার কারণে কিছু পুকুর ভরাট হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ৮-১০টি পুকুরের গার্ডওয়াল নির্মাণ করেছে করপোরেশন।
সিলেট নগরীর উল্লেখযোগ্য দিঘিগুলোর মধ্যে রয়েছে- লালদিঘি, রামেরদিঘি, মাছুদিঘি, বেকাদিঘি, মজুমদারদিঘি, দস্তিদারবাড়ি দিঘি, সাগরদিঘি, চারাদিঘি, ধোপাদিঘি, মুরারীচাঁদদিঘি, ইন্দ্রানীদিঘি, কাজলদিঘি, কাস্টঘরদিঘি, কাজিরদিঘি, ব্রাহ্মণশাসনদিঘি। এসব দিঘি এক সময় নগরীতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড কিংবা পানি সংকটে ছিল প্রধান ভরসাস্থল। কিন্তু গত দুই দশকে অধিকাংশ দিঘিই ভরাট ও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সর্বশেষ ভরাট হয়েছে রায়নগর এলাকার একটি দিঘি।
সরকারি দাগ খতিয়ানে থাকা এসব পুকুর, দিঘি ছাড়াও নগরীর অধিকাংশ মসজিদের সামনে ছোট ছোট পুকুর এখন সিলেটবাসীর কাছে শুধু স্মৃতি। আন্দোলন ও প্রতিবাদ হলেও হয়নি কিছুই।
সরেজমিন দেখা গেছে, নগরীর মীর্জাজাঙ্গাল-তালতলা এলাকার মাছুদিঘি কয়েক বছর আগে ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক এলাকা। কিন ব্রিজের উত্তরে সুরমা নদীর পাড় ঘেঁষে থাকা বেকাদিঘি ভরাট করে হয়েছে জালালাবাদ পার্ক। ধোপাদিঘির অংশবিশেষ দখল করে ওসমানী শিশুপার্ক ও মসজিদ নির্মিত হয়েছে। মাইক্রোবাস চালকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে খানিকটা। লালদিঘিতে গড়ে উঠেছে মার্কেট। চারাদিঘি ভরাট করে বানানো হয়েছে বাসাবাড়ি। কাস্টঘরদিঘি সংকুচিত হতে হতে পরিণত হয়েছে ছোট ডোবায়। প্রায় প্রত্যেক দিঘিরই ঘটেছে এমন বিপর্যয়। যেগুলোর বিপর্যয় ঘটেনি, সেগুলো আবার সংরক্ষণের অভাবে হয়ে পড়েছে ব্যবহারের অযোগ্য।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অতীতে বারবার আমরা পুকুর বাঁচাতে আন্দোলন করেছি। সরকার ও সিটি করপোরেশন হার্ডলাইনে না থাকলে বাদবাকি পুকুর ও দিঘি রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই আল হাদী বলেন, নগরীর দিঘিগুলো শুধু জলাধার ছিল না। এগুলো ইতিহাসের অংশও। দিঘি ভরাটের মাধ্যমে সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হচ্ছে। পরিবেশও নষ্ট করা হচ্ছে।
সৌজন্যে : সমকাল