হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের নসরতপুরের বাসিন্দা ফারুক মিয়ার ছেলে মো. তানভীর (১৯) গত ২৪ জানুয়ারি নিখোঁজ হন। একমাত্র সন্তানকে না পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তার পরিবার। পরে তানভীরের পরিবার ঘটনাটি পুলিশকে জানায়। তারা জানায়, তানভীরকে ফেরত পাওয়ার বিনিময়ে ৮০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। বিষয়টি জানার পরই তদন্ত শুরু করে পুলিশ। নিখোঁজের দু’দিন পর তানভীরের লাশ পাওয়া যায়।
হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বেরিয়ে আসে মূল কাহিনি। একই এলাকার বাসিন্দা জনৈক সৈয়দ আলীকে ছয় বছর আগে অপমান করেছিলেন তানভীরের বাবা ফারুক। বাবার অপমানের প্রতিশোধ নিতে ছয় বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরার পর ফারুকের একমাত্র সন্তানকে টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। একই এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ আলীর ছেলে উজ্জ্বল মিয়া (২৬) ও তার দুই বন্ধু মো. জাহিদ (২২) ও শান্ত (২২) এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে জানায় পুলিশ। গতকাল বুধবার তানভীর হত্যার ঘটনায় শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন উজ্জ্বল ও শান্ত। পুরোনো ক্ষোভ পুষে রেখে এতদিন পর এমন নিষ্ঠুর হত্যার ঘটনায় হতবাক ভুক্তভোগীর পরিবারও।
জানা গেছে, ছয় বছর আগে তানভীরের প্রতিবেশী উজ্জ্বল তাদের বাড়ির পাশে সবজি-ফল চাষ করতেন। সেই জমিতে চাষ করা কলা উজ্জ্বল বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যান। তখন ভিকটিম তানভীরের বাবা ফারুক মিয়া উজ্জ্বলকে উদ্দেশ করে বলেন- ‘তুই এই কলা চুরি করে এনে বাজারে বিক্রি করছিস।’ কলা বিক্রির ঘটনা নিয়ে বাজারে সালিশ হয়। ওই সালিশে ফারুক মিয়া অপমান করেন উজ্জ্বলের বাবা সৈয়দ আলীকে। বাজারে প্রকাশ্যে সবার সামনে বাবাকে এই অপমানের কথা ভুলতে পারেননি উজ্জ্বল। ধীরে ধীরে তার মনের কোণে জমতে থাকে ক্রোধ ও প্রতিশোধের নেশা।
এরই মাঝে সৈয়দ আলী তার ছেলে উজ্জ্বলকে ইরাকে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু উজ্জ্বল বাবার অপমান ভুলতে পারেননি। ছয় বছর পর দেশে ফিরে আসেন উজ্জ্বল। ছক কষতে থাকেন কীভাবে তার বাবার অপমানের বদলা নেওয়া যায়। পরিকল্পনা করেন- ফারুক মিয়ার একমাত্র ছেলে তানভীরকে অপহরণ করবেন। তিনি তার পরিকল্পনার কথা এক পর্যায়ে জানান জাহিদকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী উজ্জ্বল এবং জাহিদ তানভীরকে প্রথম দফায় অপহরণের করেন। ওই যাত্রায় বেঁচে যান তানভীর। এরই মাঝে উজ্জ্বল আরও কয়েক দফা পরিকল্পনা করেও ব্যর্থ হন। পরে জাহিদের মাধ্যমে হত্যার নীলনকশায় অংশ নেন শান্ত নামে আরেক তরুণ। ২৪ জানুয়ারি উজ্জ্বল, জাহিদ এবং শান্ত মিলে তানভীরকে হত্যার ছক কষেন। উজ্জ্বলকে শান্ত জানান, তানভীরকে ঘরের বাইরে আনার দায়িত্ব তার। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় শান্ত কৌশলে তানভীরকে ওই এলাকার একটি পুকুর পাড়ে ডেকে আনেন। এরপর উজ্জ্বল ঘটনাস্থলে যান। এক পর্যায়ে উজ্জ্বল কৌশলে তানভীরের ব্যবহূত মোবাইল ফোনটি তার কাছে নিয়ে নেন। তাদের পরিকল্পনা মতো উজ্জ্বল তানভীরের গলায় সুতা দিয়ে ফাঁস দেন। শান্ত এবং জাহিদ উভয়েই তানভীরের মুখ চেপে ধরে রাখেন যেন তিনি চিৎকার করতে না পারেন। মৃত্যু নিশ্চিতের পর পাশের মজা পুকুরে তানভীরের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় লাশ গুম করা হয়। উজ্জ্বল তানভীরের পেটে ছুরিকাঘাত করেন যেন মৃতদেহ ভেসে না ওঠে। পরে মৃতদেহটি তারা তিনজন পুকুরে কাদার নিচে চাপা দিয়ে রাখেন। এরপর জাহিদ তানভীরের বাবার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে উজ্জ্বলের পরামর্শ অনুযায়ী মুক্তিপণের জন্য ৮০ লাখ টাকা দাবি করেন। ঘটনা ভিন্ন খাতে নিতে উজ্জ্বল, শান্ত এবং জাহিদ মুক্তিপণ দাবির নাটক সাজান।
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম জানান, ক্রোধ কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তার একটি বড় উদহরণ এ ঘটনা। যে তিনজন এই ঘটনায় জড়িত, তারা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। উজ্জ্বলের গতিবিধি সন্দেহজনক হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরে জাহিদ এবং শান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।