সুনামগঞ্জ
নেই সড়ক-ঘরবাড়ি, সুনামগঞ্জের নেতার বাড়ির পাশে ‘হাস্যোজ্জ্বল’ সেতু!
ছবিটা দেখুন। ভালো করে দেখুন। পুরোটায় চোখ দেবেন না। শুধু সেতু দেখুন। কী রঙিন, ঝাঁ-চকচকে না? আধুনিক কবিতার মতো করে বললে, ‘হাস্যোজ্জ্বল’ সেতু! কিন্তু একজন নেতা বা বিশিষ্ট ব্যক্তির কাতুকুতু ছাড়া এই সেতু কি হাসতে পারত?
না না, পারত না। তাই তো এই সেতুর শেষ হয়েছে ধানি জমিতে। অনেকে সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু বিষয়টার মাজেজা একটু বোঝার চেষ্টা তো করুন! সেতুর কাজ পৃথক থাকা দুই প্রান্তে সংযোগ তৈরি করা। ভেবে দেখুন, যাঁর কারণে এই সেতু হয়েছে, তিনি এতটাই কৃষিবান্ধব যে কৃষির সঙ্গে সাধারণ মানুষের বন্ধন তৈরি করতে সরকারের (অনুচ্চারে সাধারণ মানুষের) কোটি কোটি টাকা খালে ফেলেছেন। এমনকি এর জন্য দুই গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধাও বিসর্জন দিয়েছেন। এবার বলুন, এতটা ত্যাগ আগে দেখেছেন? আবেগে চোখে পানি আসেনি? না এলে গ্লিসারিন দিন, প্লিজ। কাঁদতে আপনাকে হবেই!
অনুমান ও ধারণা না মেলায় এখন সেতুগুলোর কাঠামো পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ফলে বাড়তি খরচ হবে ২ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। এই ১৩০ সেতুর মধ্যে ৯টির কাজ শেষ হয়েছে। তা দেখতে গিয়েই তিনটি এমন সেতুর খোঁজ মিলেছে, যেগুলো নেতাদের কাতুকুতুতে দন্ত বিকশিত করেছে।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তালিকার ওপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দেশের ৪০ জেলার ৯৪টি উপজেলায় মোট ১৩০টি সেতু নির্মাণের একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ৩ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ’ নামের প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের সময় সমীক্ষা করা ছিল মাত্র ৩৬টি সেতুর। বাকি ৯৪টি সেতুর কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সে সময় একেকটি সেতুর দৈর্ঘ্য ঠিক করা হয়েছিল অনুমানের ওপর ভর করে। আর খরচ ধরা হয়েছিল ধারণার ওপর ভিত্তি করে। অনুমান ও ধারণা না মেলায় এখন সেতুগুলোর কাঠামো পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ফলে বাড়তি খরচ হবে ২ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। এই ১৩০ সেতুর মধ্যে ৯টির কাজ শেষ হয়েছে। তা দেখতে গিয়েই তিনটি এমন সেতুর খোঁজ মিলেছে, যেগুলো নেতাদের কাতুকুতুতে দন্ত বিকশিত করেছে। ওপরের ছবিটি তারই নিদর্শন। এর মধ্যে আবার নেতার বাড়ির পাশে সেতু তৈরির ঘটনাও আছে।
উফ বাবা, হাঁপ ধরে গেল। এতগুলো কথা একসঙ্গে এভাবে বলা সহজ নাকি? তাও আবার হাজার হাজার কোটির হিসাব এবং অনুমান ও ধারণার কাহিনিও আছে। কয়েক শ বোতল হজমিতেও তো এসব হজম করা কঠিন। ধরুন, আপনি বাড়ি বানাবেন। অনুমানের ওপর কি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করবেন? নিশ্চয়ই মাথা দুদিকে নেড়ে প্রবল অসম্মতি জানাচ্ছেন। কিন্তু কারও কারও সেই অসম্মতিই এসব সেতুতে এসে সম্মতিতে রূপ নিয়েছে। অসম্মতি ও সম্মতির মধ্যে সংযোগ সেতু বানিয়েছে নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চাওয়া। আর তাতেই নেতাদের বাড়ির পাশে বসেছে রঙের মেলা। আহা! কী রঙিন, কী জীবন্ত! গৌরী সেনের পয়সাতেই তো এমন মেলা করতে হয়।
বাংলা প্রবাদে গৌরী সেন একজনই, তিনি বোধ করি ধনীই ছিলেন। কিন্তু এই বাংলায় এখন গৌরী সেন অজস্র। আমি-আপনি সবাই গৌরী সেন। তা না হলে আমাদের পয়সায় এমন মচ্ছব কেন করা হবে, বলুন? তবে আমি বলি, করুক। এই টানাটানির জীবনে তাতেও যদি নিজেকে গৌরী সেনের কাছাকাছি নেওয়া যায়, মন্দ কী? জানেনই তো, পাগলের সুখ মনে মনে…যা অবস্থা, একদিন হয়তো রাস্তায় কাগজ কুড়াতেই হবে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ভাদগাঁওয়ে চেলার খালের ওপর নতুন সেতু নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সেতু থেকে নামলে চোখে পড়ে শুধু চাষিদের আবাদ করার মাঠ। সেতুর সঙ্গে নেই কোনো সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামোর চিহ্ন। সম্প্রতি ভাদগাঁওয়ের আনুজানি গ্রামে আপনারা কি সমালোচনা করতে চান? প্লিজ, করবেন না। নেতার বাড়ির পাশে সেতু হতেই পারে। জনগণের জন্য নেতারা কত্ত কষ্ট করেন। এতটুকু প্রতিদান দিতেও আপনাদের যদি হাঁপ ধরে যায়, তবে কীভাবে চলবে দেশ? এ বেলা নিজে কষ্ট করে একটু মেনে নিন। নেতার হয়তো বাড়ির পাশে সেতু রাখলে হাওয়া খেতে সুবিধা হয়। আমরা আসলেই পরশ্রীকাতর। অন্যের হাওয়া খাওয়াও সহ্য হয় না। বেশি অসহ্য লাগলে কষে পান্তা-মরিচ খেয়ে ঘুম দিন তো। আর স্বপ্ন দেখুন। তা ‘দু’ নাকি ‘সু’ হবে, সে আপনার পছন্দের ব্যাপার।
এবার একটু বাংলা ব্যাকরণের জগৎ থেকে ঘুরে আসা যাক। ব্যাকরণ অনুযায়ী সেতু বিশেষ্য শব্দ। আর নেতা বিশেষণ। বিশেষ্যকে বিশেষায়িত করতে বিশেষণকে তো আগেই বসতে হবে। তাই নেতা আগে, সেতু পরে। এ কারণেই নেতার বাড়ির পাশে সেতু লাগে। আর তা ধ্যানধারণার ওপর ভিত্তি করেই বানাতে হয়। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজে কি হিসাব করা সাজে?
সুতরাং, এ নিয়ে আর বাহাসের সুযোগ নেই। নেতার বাড়ির পাশে সেতু হাসবেই। এটি ব্যাকরণগত উপায়ে সিদ্ধ। পারলে ঠেকান তো দেখি! মনে রাখবেন, নাম বললে কিন্তু …
সৌজন্যে : প্রথম আলো